বায়তুল মোকাররম: ঢাকার হৃদপিণ্ডে এক টুকরো কাবার প্রতিচ্ছবি
ঢাকার ব্যস্ততম এলাকা পল্টন। চারদিকে গাড়ির হর্ন, মানুষের কোলাহল আর হকারদের হাঁকডাক। কিন্তু এই ব্যস্ততার ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল সাদা ইমারত, যা দেখলেই চোখের পলক থমকে যায়। এটি আমাদের জাতীয় মসজিদ— বায়তুল মোকাররম।
শুরুর সেই গল্প
আজ থেকে প্রায় ৬৫ বছর আগের কথা। ১৯৫৯ সালে ঢাকা তখন কেবল বড় হতে শুরু করেছে। বিশিষ্ট শিল্পপতি আব্দুল লতিফ ইব্রাহিম বাওয়ানি এবং তাঁর ভাতিজা ইয়াহিয়া বাওয়ানি পরিকল্পনা করলেন এমন একটি মসজিদ বানানোর, যা কেবল ইবাদতের জায়গা হবে না, বরং হবে স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন।
১৯৬০ সালের ২৭ জানুয়ারি এই বিশাল কর্মযজ্ঞের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। সেই সময়ের নামকরা সিন্ধি স্থপতি এ. এইচ. থারিয়ানিকে দায়িত্ব দেওয়া হয় এর নকশা করার জন্য।
গম্বুজহীন এক বিস্ময়
সাধারণত আমরা জানি, মসজিদ মানেই বিশাল গম্বুজ আর লম্বা মিনার। কিন্তু বায়তুল মোকাররমের নকশা আপনাকে অবাক করে দেবে। এটি দেখতে অনেকটা পবিত্র কাবা শরিফের মতো ঘনকাকৃতির। স্থপতি চেয়েছিলেন ঢাকার প্রচণ্ড গরমে মসজিদের ভেতরটা যেন ঠান্ডা আর বাতাস চলাচলের উপযোগী থাকে। তাই চিরাচরিত গম্বুজের বদলে তিনি বেছে নিয়েছিলেন আধুনিক এই জ্যামিতিক নকশা।
১৯৬৩ সালের ২৫ জানুয়ারি শুক্রবার, প্রথমবারের মতো এখানে জুমার নামাজ আদায় করা হয়। সেই দিন থেকেই এটি ঢাকার মুসলিম উম্মাহর মিলনমেলায় পরিণত হয়।
স্থাপত্যের জাদু
বায়তুল মোকাররমের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এর বিশালতা। মসজিদের ভেতরটা কয়েক তলায় বিভক্ত। এর বারান্দাগুলো এবং ওপরের খোলা ছাদ থেকে বিকেলের আলো যখন মসজিদের মেঝেতে এসে পড়ে, তখন এক অপার্থিব সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয়। মসজিদের প্রবেশপথের বাগান এবং নিচের মার্কেট মিলিয়ে এটি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ এলাকা।
আশি দশকে বর্তমানের আধুনিক মিনারটি যুক্ত করা হয়, যা মসজিদের সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বর্তমানে প্রায় ৪০,০০০ মানুষ একসঙ্গে এখানে নামাজ আদায় করতে পারেন।
ব্যস্ত শহরের শান্ত কোল
বাইরে যখন প্রচণ্ড জ্যাম আর রোদের তাপ, তখন বায়তুল মোকাররমের ভেতরে প্রবেশ করলেই এক অদ্ভুত শান্তি অনুভূত হয়। সাদা মার্বেল পাথরের মেঝে আর উঁচু সিলিংয়ের কারণে ভেতরের বাতাস সবসময় শীতল থাকে। জুমার দিনে যখন হাজার হাজার মানুষ কাতারবদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়, তখন এক অভূতপূর্ব ঐক্যের দৃশ্য ফুটে ওঠে।
শেষ কথা
বায়তুল মোকাররম কেবল একটি ইমারত নয়; এটি আমাদের জাতীয় পরিচয়, আমাদের ইতিহাস আর হাজারো মুসুল্লির আবেগের জায়গা। আপনি যদি কখনো ঢাকার জিরো পয়েন্টে আসেন, তবে এই স্থাপত্যের মায়ায় একবার হলেও ঘুরে যাবেন।